ফেসবুক হবে সবচেয়ে বৃহৎ শপিং মল

বাংলাদেশে ই-বাণিজ্য’র (E-Commerce) বাজার শুরু হয় ২০১৩-১৪ সালের দিকে। সেটা এখন প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের বাজারে পরিণত হতে চলেছে। বাজার বিশ্লেষকগণ মনে করছেন যে, দেশে স্মার্ট ফোনের সহজ লভ্যতা ও ইন্টারনেটে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগই ই-বাজার সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের মাইন্ডসেটও একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। ভূমিকা রেখেছে বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনা রোগ। এ দেশের সাধারণ মানুষ শপিং মলে বা বাজারে গিয়ে দেখে-শুনে, দর যাচাই করে কেনা-কাটা করতে অভ্যস্ত। ঘরে বসে ফোনে বা ল্যাপটপে বসে পণ্য কেনা-কাটা তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ছিলো। আবার কিছু দুঃস্কৃতিকারীর খপ্পরও ছিলো সাধারাণ মানুষের আস্থা অর্জনে বড় অন্তরায়।

গত বছরের মার্চে যখন মানুষ লকডাউনে বাসায় থাকতে বাধ্য হয় তখনই ফেসবুক ভিত্তিক বাণিজ্য হয়ে উঠে জনপ্রিয় মাধ্যম। সেটা বিক্রেতা বা ক্রেতা উভয় দিক থেকে। শুরুর দিকে এফ-কমার্স বা ফেসবুক বাণিজ্য ছিলো লাইফস্টাইল পণ্য নিয়ে। তবে এখন সব ধরনের পণ্যই ফেসবুকে পাওয়া যায়। এমন কি যাদের ই-কমার্স প্লাটফর্ম আছে তাদেরও ফেসবুক পেজ বা গ্রুপ আছে সরাসরি ক্রেতা আকর্ষণ ও বিক্রয় বাড়ানোর জন্য। এছাড়া ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে পণ্যের বিনিময় হিসেবে অর্থ দেয়াও এখন একটি সহজ ব্যাপার যেটা মোবাইল ফাইন্স্যাস সার্ভিস (এমএফএস) এর মাধ্যমে হচ্ছে। নগদ, বিকাশ বা রকেটের মাধ্যমে যে পেমেন্ট গেটওয়ে ফেসবুক কারবারীগণ পাচ্ছেন সেটা অভূতপূর্ব সফলতা এনে দিয়েছে।

ফেসবুকে এখন কমিউনিটি গ্রুপ খুলেও এফ-বাণিজ্যকে সম্প্রসারণে বেশ কয়েকজন কমিউনিটি লিডার (ফেসবুকও কমিউনিটি লিডার বলে) ই-বাণিজ্য প্রসারে রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তারা আবার নানানভাবে নিজেদের মধ্যে প্রোগ্রামও করে থাকে। যার ফলে ক্রেতা-বিক্রেতা-সরবরাহকারীর মধ্যে একটা সেঁতু-বন্ধন তৈরী হচ্ছে ও পরস্পর আস্থা তৈরী হচ্ছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ঘটা করে এখন কমিউনিটি লিডারদেরকে নিয়ে গ্লোবালি ভার্চুয়াল সামিট ও মিটিং করে। সেখানে তারা নানান দিক নির্দেশনাও দিয়ে থাকে। আমি একজন কমিউনিটি লিডার হিসেবে সেসব মিটিং এ যুক্ত থেকেছি। ফেসবুকের এহেন মিটিং এর উদ্দ্যেশ্য হলো তারা চায় এফ-কমার্স এর রেভিনিউ বা বিক্রয়মূল্য আমাজনের চেয়ে উপরে নিতে!

আমরা যদি গত ৫-৬ বছরের বেশ কিছু অনুঘটককে বা ফ্যাক্টরকে আলোচনা করি তবে এ দেশে ই-কারবারের প্রসারের সবিস্তার জানা যাবে। যেমন-

(ক) বাংলাদেশের জনমিতি
১. বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬৫.৫ মিলিয়ন, যা গত বছরের জানুয়ারী হতে এ বছরের জানুয়ারীতে বৃদ্ধি হলো ১.৬ মিলিয়ন বা ১.০% বেশি।
২. মোট জনসংখ্যার ৪৯.৫ শতাংশ মেয়ে ও ৫০.৫ শতাংশ ছেলে।
৩. মোট জনসংখ্যার ৩৮.৫ শতাংশ বসবাস করে শহরে ও বাকি ৬১.৫ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে।

(খ) ইন্টারনেটের ব্যবহারঃ
১. ২০২১ এর জানুয়ারী মাসে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিলো ৪৭.৬১ মিলিয়ন।
২. ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯% (২০২০ সালের জানুয়ারী মাসের তুলনায়)।
৩. জানুয়ারী ২০২১ এ মোট ইন্টারনেটে অনুপ্রবেশ বা পেনিট্রেশান এর সংখ্যা ২৮.৮ শতাংশ।

(গ) সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যাঃ
১. জানুয়ারী ২০২১ এর ডেটানুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৪৫.০০ মিলিয়ন জনগণ সোশ্যাল মিডিয়াতে রয়েছে।
২. জানুয়ারী ২০২১ এ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা জানুয়ারী ২০২০ এর তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫ শতাংশ।
৩. জানুয়ারী ২০২১ এ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেছে তার সংখ্যা মোট জনসংখার ২৭.২ শতাংশ।

(ঘ) মোবাইল সংযোগঃ
১. জনসংখ্যার চেয়ে এ দেশে মোবাইলের সংযোগকারীর সংখ্যা বেশি! ১৬৫.৮ মিলিয়ন মোবাইল সংযোগ রয়েছে এ দেশে।
২. ২০২০ এর জানুয়ারীর তুলনায় সংযোগকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১.৭ মিলিয়ন যা মোট জনসংখ্যার ১০০.২ শতাংশ।
৩. দেশের জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ যুবক যাদের বয়স ২৫-৩৯ বছর। তারা ফিচারফোন বা স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি অতি আগ্রহী।

(ঙ) ঢাকা শহরের ট্রাফিকঃ

বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, ঢাকাতে গত ১০ বছরে গড় ট্রাফিকের গতি ২১ কিলোমিটার হতে ৭ কিলোমটার মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে একটু বেশী। বিশ্বের সবচেয়ে ঘন বসতি সম্পন্ন এই শহরের লোকজন তাই এখন বাজার করার কথা শুনলে ভয় অনুভব করে। অন্য একটি তথ্যে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে ঢাকার মানুষের ৩২ মিলিয়ন কর্মঘন্টা নষ্ট হয়। সে বিবেচনায় মানুষ এখন ই-বাণিজ্যের প্রতি আস্থা রাখছে।

(চ) ঐতিহ্যবাহী পণ্য বা আঞ্চলিক খাবারের প্রাপ্যতাঃ

ফেসবুক বাণিজ্যের কল্যাণে এখন যশোর অঞ্চলের ঐতিহ্য যেমন খেঁজুরের গুড়-পাটালী, চাল-কুমড়োর বড়ি, নোয়াখালী অঞ্চলের বিশেষ খাবার ”মারিচখোলা” বা খুলনা অঞ্চলের চুঁইঝালের মাংস রান্না ঢাকার বনশ্রীর বাসায় বসে পাওয়া যায়। এ কারণেও অনেকে ফেসবুকে বাণিজ্য ও কেনাকাটা করে থাকে। তারা হয়তো কোন ই-বাণিজ্যের প্লাটফর্ম থেকে কখনোই কিনে না কিন্তু ফেসবুক পেজ বা গ্রুপ থেকে সহসা কিনে। এমনিভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে ফেসবুক বাণিজ্য। আমাদের গ্রুপের দিপা সাহাসহ বেশ কয়েকজন মিলে শুরু করেছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী জামদানির ই-বাণিজ্য। তারা মাত্র ৩ মাসে পেয়েছে সাফল্য।

উপরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে সহজে অনুধাবনযোগ্য যে, ফেসবুক কমার্স তথা ই-কমার্স এর সম্ভাবনা কতখানি। এছাড়া সরকার ই-বাণিজ্য প্রসারে সরাসরি অর্থায়ন, ট্রেনিং ও লজিস্টিক্স সাপোর্ট হিসেবে পোস্ট অফিসকে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। মুজিব জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে আইসিটি মিনিস্টার সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন যে, ২০০০ জন মহিলা উদ্যোক্তা ৫০ হাজার টাকা করে অফেরতযোগ্য অনুদান পাবেন। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, অনুদান যারা পেতে চলেছেন তারা ই-ক্যাব ও উই নামক একটি ফেসবুক গ্রুপের নারী উদ্যোক্তাগণ। এদের অধিকাংশের কোন নিজস্ব প্লাটফর্ম নেই। তারা ফেসবুক পেজ বা উক্ত গ্রুপের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মঃপ্রকাশ করেছেন। তাদের মূলধন হলো একটি ফিচারফোন বা স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ।

ই-ক্যাবের তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশে ই-বাণিজ্যে এফ-কমার্স বা ফেসবুকে বেঁচা-কেনার পরিমাণ ৩.১২ বিলিয়ন ডলারে ছাড়াবে ২০২৩ সালের মধ্যে। একটি কমিউনিটি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গত এক বছরে আমার সাথে সংশ্রব ঘটেছে এমন উদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ১০০ এর বেশি। যারা কখনো ভাবে নি একদিন তারা ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের পণ্য বিক্রয় করবে। কিন্তু এমনও উদাহরণ আছে যে শুধু রান্না করা খাবার বিক্রয় করে মোট রেভিনিউ পেয়েছে ৫ লক্ষ টাকার অধিক। এখনতো অনলাইন নিউজ পোর্টাল খুললেই দেখা যায় কোন্ কোন্ উদ্যোক্তা লাখপতি হয়েছেন। আমাদের গ্রুপটি শুধুমাত্র একটি বিশেষ কমিউনিটির মানুষদের জন্য কাজ কওে যাচ্ছে। যার সদস্য সংখ্যা মাত্র ৩৩০০ জন। সেখানেও গত ৬ মাসে ২০ জন উদ্যোক্তা লক্ষাধিক টাকার পণ্য বিক্রয় করতে সক্ষম হয়েছে ও গ্রুপের মোট বিক্রয় দাঁড়িয়েছে ১.৫ কোটি টাকার অধিক। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই এর আগে কোন ধরনের ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ছিলো না ও তাদের একটি ফেসবুক পেজ, একটি ইউটিউব চ্যানেল বা একটি ইনস্টাগ্রাম হিসাব খোলা ছাড়া আক্ষরিক অর্থে তেমন কোন বিনিয়োগ নেই। ফেসবুকও কোন কমিশন চায় না। সরকার শুধুমাত্র ৫ শতাংশ ভ্যাট দাবি করে।

ব্যবসায় সৃষ্টির এমন সহজ মাধ্যম ফেসবুকের আগে কেউ কখনো দেখে নি। তবে ক্রেতাদের ব্যাপকহারে আস্থার জায়গা তৈরী হতে এখনও সময় লাগবে। এই একটি মাধ্যম দিয়ে গ্রামীণ জনপদকে সহজে যুক্ত করা যায় ও তার ক্ষেতের পণ্যটিও সরাসরি ক্রেতার কাছে বিক্রয়ের ব্যবস্থা কার যায়। দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ নারীকে যুক্ত করা যায় মোট জাতীয় উৎপাদনে। ফেসবুক বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য দরকার সঠিক সরকারি বেসরকারি দিক-নির্দেশনা, কর্ম -পরিকল্পনা, ও পরিকল্পিত সাহায্য-সহযোগিতা। তবেই এ দেশে ফেসবুক হবে সবচেয়ে বৃহৎ শপিং মল।

 

লেখকঃ প্রতিষ্ঠাতা, ই- কমার্স মাসেন্ডাইজ এলায়েন্স (ই-সিএমএ)

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.