‘এলডিসি থেকে উত্তরণে রয়েছে চ্যালেঞ্জ’

স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জনে সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানোর পাশাপাশি রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

আজ শনিবার (১৩ মার্চ) বিকেলে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ আয়োজিত ‘উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ: প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিশাল অর্জন’ শীর্ষক লাইভ ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশেষজ্ঞরা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন।

ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ ড. চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।

আলোচক হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশের উপ উপাচার্য ড. শেখ মামুন খালেদ এবং ট্রাস্টি বোর্ডের উপদেষ্টা মোহাম্মদ এ আরাফাত।

এলডিসি থেকে উত্তরণের কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে জানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘তবে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। এখন দরকার পরিকল্পনা নিয়ে সময়াবদ্ধ কর্মসূচির মাধ্যমে কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজেদের সক্ষম করে তোলা। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বৈষম্য কমিয়ে সুষম প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করা।’

প্রতিযোগী সক্ষমতা উন্নয়নের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘নিজেদের সক্ষমতা উন্নয়নের জন্য রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ, দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তির সম্প্রসারণ এবং উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা জরুরি। এর বাইরে বৈদেশিক বাণিজ্য নীতির আওতায় বাংলাদেশকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি, বাই লেটারেল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট অথবা সাব রিজিওনাল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট-আরসিইপি, বিমসটেক এমন সব জোটে ভিড়তে হবে।’

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যারা বাংলাদেশকে নিয়ে এক সময় সমালোচনা করেছে তাদের জন্য এখন বাংলাদেশ একটি উদাহরণ। অনেক দেশই বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন চূড়ান্ত ধাপে যেতে হলে অনেক কিছু গুরুত্বের সঙ্গে করতে হবে। বাংলাদেশের গড় সংরক্ষণ শুল্কহার অনেক বেশি। অর্থনীতি এখনও সুরক্ষা নির্ভর। বাংলাদেশকে আরও উদার নীতি গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে সমস্যা হবে। চেষ্টা করতে হবে জিএসপি প্লাস পাওয়ার জন্য। চীন, জাপান বাংলাদেশের বড় মার্কেট। এগুলো ধরতে হবে।’

প্রতিযোগী সক্ষমতার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ দেন তিনি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান এলডিসি থেকে উত্তরণের বিভিন্ন সুবিধা তুলে ধরেন। তবে এই উত্তরণের অভিঘাতগুলোর সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।

মোস্তাফিজুর চারটি অভিঘাতের সম্ভাবনা তুলে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, আমাদের বাজার সুবিধা। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক সে সম্পর্কের মধ্যে একটা পরিবর্তন হবে। তৃতীয়ত, আমাদের অভ্যন্তরীণ নিজস্ব নীতিমালার ওপর প্রভাব। চতুর্থত, এনভায়রনমেন্ট বা যেগুলোতে শৈথিল্য আছে সেখানে আমাদের অনেক বড় পরিবর্তন হবে।’

তিনি বলেন, ‘ওই নিয়ম নীতিগুলো যদি আমরা মেনে না চলি, তাহলে আমাদের ডব্লিউটিওতে যে ডিসপিউট সেটলমেন্ট বডি আছে সেখানে অন্যান্য দেশ আমাদের বিরুদ্ধে কেইস নিয়ে আসতে পারে এবং সেটার ফলে নেতিবাচক একটা প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে পারে।’

বিএসইসি চেয়ারম্যান রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, ‘তিনটি সূচকে বাংলাদেশ ভালো করলেও চূড়ান্ত ধাপে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে আরও অনেক কিছু করতে হবে।

‘কৃষি খাতে বাংলাদেশ ভালো করছে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত কৃষি খাত ভালোই করে যাচ্ছে, সেজন্য আমরা স্বনির্ভর হতে পেরেছি। আমাদের পোশাক খাত বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা বা জিএসপির কারণে আমরা এই সুবিধা পাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সবাই চাই ভালোর দিকে যেতে। মাথাপিছু আয় সাড়ে পাঁচশ ডলার ১২ বছরের মধ্যে চারগুণ বাড়াতে সক্ষম হয়েছি। এই প্রবণতা ধরে রাখা গেলে এটা পাঁচ হাজার ডলারে উন্নীত করা কঠিন হবে না।’

কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশের উপ উপাচার্য ড. শেখ মামুন খালেদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দিন বদলের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সেটা তিনি করতে পেরেছেন।

‘২০১০ সালে আমাদের জিডিপি ছিল ১১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ এ হয়েছে ৩৭৮ বিলিয়ন ডলার। আমরা এখন ৩৫তম মডেল ইকোনমি। ২০১০ সালে আমাদের জিপিডি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২০ এ কোভিডের পরেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।’

উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে বেশ কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় জানিয়ে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের উপদেষ্টা মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হওয়ার আমাদের যে গোল, সেখানে আমরা এক লাফে যেতে পারব না। আমাদের কিন্তু প্রসেসে যেতে হবে। আমাদের স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল হতে হবে, সেখান থেকে গ্র্যাজুয়েলি উন্নত দেশের কাতারে যেতে হবে।’

উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ ড. চৌধুরী নাফিজ সরাফাত বলেন, ‘যে বাংলাদেশ এক সময় পরিচিত ছিল বন্যাকবলিত, দারিদ্রপীড়িত দেশ হিসেবে, সেই দেশই এখন সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল; অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বের বিস্ময়। এটা কেবলই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী এবং জাদুকরি নেতৃত্বের কারণে।’

বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্র তুলে ধরে ড. চৌধুরী নাফিজ সরাফাত বলেন, ‘এই অর্জনের কাণ্ডারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছে নয়, বিশ্বের কাছেই এখন তার পরিচিতি- দারিদ্র্য দূরীকরণের জাদুকর।’

উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতি সবাইকে আস্থা রাখার আহ্বান জানান ড. চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।

এর আগে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এই সুসংবাদ নিয়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের এই গৌরব নতুন প্রজন্মকে উৎসর্গ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এই অর্জন উৎসর্গ করছি- দেশের নতুন প্রজন্মকে। যারা আজকের বাংলাদেশকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবে।’

তিনটি সূচককে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা হিসেবে মূল্যায়ন করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (ইউএন-সিডিপি)। সূচকগুলো হলো মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। এই তিন সূচকেই পাসের চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে বাংলাদেশ।

উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম ওঠাতে মাথাপিছু আয় ধরে রাখতে হয় ১ হাজার ২৩০ ডলার, সেখানে গত বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ২০ ডলার।

মানব উন্নয়ন সূচকে পয়েন্ট থাকতে হয় ৬৬, বাংলাদেশের আছে ৭৫.৩ পয়েন্ট। আর অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচকে মান থাকতে হয় ৩২ বা তার কম। এই সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্ট ২৫ দশমিক ২।

২০১৮ সালের মার্চে প্রথম দফায় বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। নিয়মানুযায়ী, এলডিসি থেকে বের হতে জাতিসংঘের সিডিপির পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি পেতে হয়।

জাতিসংঘের সিডিপির দ্বিতীয় দফার বৈঠক শেষে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জানানো হয়, প্রতিটি সূচকেই প্রয়োজনীয় মানদণ্ডের যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে বাংলাদেশ।

সিডিপি থেকে টানা দুইবার স্বীকৃতি পেয়ে চূড়ান্তভাবে উত্তরণে প্রস্তুতির জন্য তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়। সে অনুযায়ী ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা বাংলাদেশের। উত্তরণ প্রক্রিয়াকে মসৃণ ও টেকসই করা এবং করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বাড়তি দুই বছর সময় পেয়েছে বাংলাদেশ।

সে হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠবে ২০২৬ সালে।

অর্থসূচক/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.