প্রতি জেলায় হচ্ছে হিজড়াদের মাদ্রাসা

কামরাঙ্গীরচর লোহার ব্রিজ পেরিয়ে একটু এগোলেই ৩ তলা ভবন। ভবনের ৩য় তলার বেলকনি ঘেঁষে সাঁটানো সবুজ ব্যানার। এতে সাদা হরফে বড় লেখা- দাওয়াতুল কোরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসা।

‘হিজড়ারাও মানুষ’- এ স্লোগানকে সামনে রেখে সম্প্রতি রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে শুরু হয়েছে দেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসা। আর এই হিজড়া, বৃহন্নলা, কিন্নরী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের বিনামূল্যে ধর্মীয় শিক্ষা এবং শিক্ষা উপকরণের দায়িত্ব নিয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আহমদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশন।

কর্তৃপক্ষ বলছেন, একজন হিজড়াও যেন কোরআনের আলো থেকে বঞ্চিত না হন সে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা।

অল্প সময়ের মধ্যেই রাজধানী পেরিয়ে মফস্বলেও তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসা ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এরইমধ্যে ঢাকার বাইরের দুই জেলায় ছড়িয়েছে এ কার্যক্রম। রোজার আগেই আরো বেশ কয়েক জেলায় কার্যক্রম বিস্তারের পরিকল্পনা রয়েছে।

এ বিষয়ে মাদ্রাসাটির দায়িত্বে থাকা মাহমুদ আল হাসান অর্থসূচককে বলেন, আমরা গোপালঞ্জে দ্রুত আমাদের শাখা করবো। এরপর রাজশাহী, বরিশাল, চট্টগ্রামসহ আরো কয়েকটি জেলায় দ্রুত আমাদের শাখা তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশারাখি চলতি রমজানের আগেই বেশ কয়েকটি জেলায় আমাদের শাখার কার্যক্রম শুরু হবে। ঢাকার ভেতরে প্রায় ১৪ জায়গায় ইতিমধ্যে আমাদের শাখা হয়ে গেছে। এখন আমরা ঢাকার বাইরে কাজ শুরু করছি।

ময়মনসিংহে তিনটি শাখা হয়েছে আমাদের। এর একটি কাচারিকান্দি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের পাশে। সিলেট তিনটি শাখা হয়েছে। আমরা দেশের ৬৪ জেলাতেই এ কার্যক্রম শুরু করতে চাই।

হিজড়া যারা আসেন তাদের থেকে আমরা কোনো ধরনের কোনো টাকা-পয়সা নেই না। তারা ফ্রিতে পড়াশোনা করেন। কোনো বৃত্তি বা আর্থিক সহায়তা হিজড়াদের করা হয় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তাদের ফ্রিতে পড়াই। এর বাইরে এখনো তাদের কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়না।

হিজড়াদের পাশাপাশি রিকশা গ্যারেজের মানুষ, অসহায়, দিনমজুর, পথশিশু, এতিমসহ আরো যারা রয়েছেন আমরা তাদের মাঝেও দ্বিনের শিক্ষা পৌঁছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা সব বয়সিদের পড়াই। কোনো ধরা-বাধা নিয়ম নেই। শিশুদের মতো অনেক বয়স্ক ব্যক্তিরাও আমাদের কাছে শিখতে আসে। তারা আমাদের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট, বলেন আল হাসান।

‘আমরা দুইভাগে শিক্ষার্থীদের পড়াই। কায়দা শিক্ষা শাখা আর কোরআন শরীফ শাখা আলাদা বসে। অনেকেই এখন অক্ষরজ্ঞান নিয়ে খুব ভালোভাবে কোরআন দেখে পড়তে পারে।’

‘হিজড়াদের মধ্যে যারা পুরুষ আকৃতির তাদের জন্য পুরুষ মাসয়ালা। আর নারীদের জন্য নারীদের মাসয়ালা। প্রথমত এখন আমরা তাদের শিখাচ্ছি কারণ তাদের তো জ্ঞান, অভিজ্ঞতা নেই। এরপর তারা যখন শিক্ষিত হয়ে যাবে, তারা নিজেরাই নিজেদের পড়াবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় হিজড়ারা পুরুষ। আমরা তাদের পার্থক্য ঠিকভাবে বুঝতে পারিনা। তারা নিজেরা এসব ভালো বুঝতে পারবেন। তারা সবাই’ই একভাবে সেজে থাকে।’

যেসব হিজড়ারা শিক্ষা নিচ্ছেন আমরা তাদের মধ্য থেকে হাফেজ, আলেম, মুফতি তৈরি করতে চাই। আমরা তাদের সব সময় উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। তাছাড়া প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতাও করা হচ্ছে। আমরা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিয়েছি, ওদের মধ্য থেকে কেউ যদি হাফেজ হতে পারে তাকে আমরা হজ করিয়ে আনবো। তাদের নিয়ে আমাদের অনেক আশা রয়েছে। আমরা পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্টীকে নিয়ে কাজ করতে চাই, যোগ করেন আল হাসান।

‘২০২০ সালের ৬ নভেম্বর আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করি। এরপর চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি নতুন বছরের সবক উদ্বোধন করা হয়। গত বছরের শুরুর দিক থেকেই আমরা কার্যক্রমগুলো অল্প অল্প করে চালিয়ে যাচ্ছিলাম।’

‘ভবিষ্যতে প্রয়োজনে হলে বাংলা, ইংরেজির মতো বিষয়গুলোও সংযুক্ত করা হবে বলে জানান তিনি। এখন আমরা আপাতত আরবিই পড়াচ্ছি। এরপর প্রয়োজন হলে বা হিজড়ারা আগ্রহ প্রকাশ করলে আমরা বাংলা এবং ইংরেজি শিক্ষা কার্যক্রমও শুরু করবো।’

পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার বিষয়টিও ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা হাতে কলমে হিজড়াদের প্রশিক্ষণ দিতে চান যাতে ভবিষ্যতে তারা নিজেদের জন্য কিছু করতে পারে।

‘ঢাকায় প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী রয়েছে আমাদের। ঢাকায় কেন্দ্র রয়েছে ১৪টি। ঢাকার বাইরে শাখা করতে পেরেছি শুধু মংমনসিংহ ও সিলেট।’

মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি মুহাম্মাদ আবদুর রহমান আজাদ বলেন, ‘‌হিজড়ারা স্কুলে যেতে পারে না, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তো অনেক দূরের কথা। তাদের কেউ কোনো কাজও দেয় না। অনন্যোপায় হয়ে যখন তারা ‌বিশৃঙ্খলা করে, তখন সবাই তাদের উৎপাত মনে করে। এই দোষ আমার নিজের, সমাজের, রাষ্ট্রের।’ মূলত এই চিন্তা থেকেই হিজড়াদের জন্য আমি মাদ্রাসা চালুর উদ্যোগ নেই।

মুফতি আজাদের বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। এরই মধ্যে বাজারে তার ২৭টি বই আছে। লেখাপড়া শেষ করে অনেক দিন পথশিশুদের পড়িয়েছেন। এখনো তিনি ও তার দল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পথশিশুদের পবিত্র কোরআন পড়ান।

মাদ্রাসার অর্থায়ন কে করছেন—জানতে চাইলে মুফতি আবদুর রহমান আজাদ বলেন, মরহুম আহমেদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশন তাদের অর্থায়ন করেছে। তারা সরকার বা বেসরকারি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সহায়তা চাননি। এ উদ্যোগ থেকে তারা কোনো লাভ চান না। তাদের ভাষায়, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারা কাজটা করতে চান। কেউ সহায়তা করতে চাইলে করতে পারেন। মাদ্রাসায় এই মুহূর্তে দশজন শিক্ষক আছেন।

কথা হচ্ছিল সোনালী হিজড়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, পবিত্র কোরআন পড়া শেখাটাকে তারা মনে করেন আর সব মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার একটা সুযোগ। সেই সঙ্গে কেউ যদি আয়–রোজগারের কোনো প্রশিক্ষণ দিত, তাহলে বাকি জীবনে আর কিছু চাওয়ার থাকতো না।

তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য একেবারে একটি আলাদা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানিয়েছেন এই কমিউনিটির সদস্যরা। এর আগে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশে আলাদা কোন মাদ্রাসা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার খবর পাওয়া যায়নি। এছাড়া মূলধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও হিজড়াদের পড়ানোর কোন ব্যবস্থা নেই বলে জানা গেছে।

দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছে একটি তিন তলা ভবনে। এর প্রতিটি তলায় প্রায় ১২০০ বর্গফুট জায়গা রয়েছে। এখানেই সব শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ব্যাচে ভাগ করে পড়াশুনার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পড়াতে ১০জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই মাদ্রাসায় পড়ার ক্ষেত্রে কোন বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি, অর্থাৎ হিজড়া জনগোষ্ঠীর যে কোন বয়সের মানুষ এই মাদ্রাসায় ভর্তি হতে পারবেন।

প্রসঙ্গত, হিজড়া জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও আবহমান কাল থেকে এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সরকার ২০১৩ সালে হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সর্বোপরি তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে সরকার নানান কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

২০১২-২০১৩ অর্থ বছর হতে পাইলট কর্মসূচি হিসেবে দেশের ৭টি জেলায় হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু হয়। এ ৭টি জেলা হলো: ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, খুলনা, বগুড়া এবং সিলেট। ২০১২-১৩ অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল ৭২,১৭,০০০(বাহাত্তর লক্ষ সতের হাজার) টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে নতুন ১৪ টি জেলাসহ মোট ২১টি জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে এবং জেলাগুলো হচ্ছে ঢাকা, গাজীপুর, নেত্রকোনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, সিলেট।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৪,০৭,৩১,৬০০ (চার কোটি সাত লক্ষ একত্রিশ হাজার ছয়শ টাকা)। ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরের কর্মসূচির বরাদ্দ ৪,৫৮,৭২,০০০.০০ (চার কোটি আটান্ন লক্ষ বাহাত্তর হাজার) টাকা।

২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ৬৪ জেলায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৬৪ জেলায় বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ১১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ৫,৫৬,০০,০০০/- (পাঁচ কোটি ছাপ্পান্ন লক্ষ) টাকা।

অর্থসূচক/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.