জীবিত অবস্থায় নিজের দেহকে মমি বানিয়ে অমর হওয়ার চেষ্টা!

‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?’- কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের এ আক্ষেপ শুধু তার একারই নয়; এর মধ্যে ধরা রয়েছে মানব সভ্যতার চিরকালীন আক্ষেপের সারাৎসার। তবে নিজের কর্মের মাধ্যমে অনেকেই মৃত্যুর পরও হাজার হাজার বছর তার অস্তিত্ব রেখে যান।

জাপানের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা নিজেই নিজের দেহটিকে মমি বানিয়ে রাখার মাধ্যমে নিজেকে অমর করে রাখার চেষ্টা করেছেন। তবে এটা কোন সহজ প্রক্রিয়া ছিল না, এক রোমাঞ্চকর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো।

কেবল জাপান নয়, চীন-সহ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও এর প্রচলন ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বেশি এই রীতির দেখা মিলবে জাপানের উত্তরে অবস্থিত ইয়ামাগাতা শহরের ইতিহাস খুঁড়লে। একাদশ থেকে শুরু হয়ে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত চলেছিল এই রীতি। কিন্তু এরপরই জাপান সরকার এটি নিষিদ্ধ করে দেয়। সরকারের মত ছিল, এটা এক ধরনের আত্মহত্যা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞার পরেও এই রীতি একেবারে গায়েব হয়ে যায়নি। বারে বারে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা হেঁটেছেন নিজেই নিজেকে মমি করে রাখার দুরূহ পথে। তারা মোটেই মানতেন না, এটা কোনও আত্মধ্বংসের প্রক্রিয়া।

মমি বললেই সবার আগে মিশরের কথা মনে পড়ে। তার সঙ্গে কিন্তু কোনও মিলই নেই জাপানের এই সন্ন্যাসীদের মমির। ধনী ফারাওদের মৃত্যুর পরে সেই দেহটিকে রাসায়নিক মাখিয়ে প্রস্তুত করা হত, যাতে পচন না ধরে। কিন্তু এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এমন আত্মমমিকরণের পদ্ধতি জানতেন, যাতে জীবিত অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে পরিণত হওয়া যায় মমিতে। একসময় শরীর নিষ্প্রাণ হয়ে আসত। বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী ধরে নেওয়া হত, তারা আলোকপ্রাপ্ত হয়েছেন। তখন তারা ‘সোকুশিনবুৎসু’।

কিন্তু কীভাবে নিজেদের দেহকে মমিতে পরিণত করতেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা? সে পদ্ধতি কম রোমাঞ্চকর নয়। এর জন্য যে ডায়েট চার্ট তাদের মেনে চলতে হত, তা রীতিমতো কঠোর। আগেই বলা হয়েছে, সেই পদ্ধতি বেশ ধীরগতির। প্রথমে অন্য সমস্ত ধরনের খাওয়াদাওয়া ছেড়ে কেবল জল, ফলমূল, বাদাম- এই সব খেতেন তারা। এর ফলে মেদ ঝরিয়ে ক্রমেই রোগা হয়ে যেত শরীর। পরের ধাপে সেসবও খাওয়া বন্ধ হয়ে যেত। তখন কেবল পাইন গাছের শিকড় ও ছালবাকল। আর সেই সঙ্গে এক বিশেষ ধরনের চা। যা তৈরি হত বার্নিশ গাছের বিষাক্ত রস দিয়ে। এই চা সন্ন্যাসীদের শরীরকে যে কোনও রকম জীবাণুর সংস্রব থেকে মুক্তি দিত। মৃত্যুর পরেও সেখানে ঘেঁষতে পারত না ম্যাগট। ফলে দেহও পচত না।

শেষে যখন শরীর একেবারে মৃতপ্রায়, তখন সেই শরীরকে মাটির নিচে এক কক্ষে রেখে দেওয়া হত। সেই কক্ষের ভিতরেই পদ্মাসনে সমাধিস্থ হয়ে থাকতেন মমি হতে যাওয়া সন্ন্যাসী। একটি বাঁশের চোঙার সাহায্যে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতেন তিনি। ওই কক্ষে থাকত একটি ঘণ্টা। রোজ সেই ঘণ্টা বাজিয়ে নিজের বেঁচে থাকার সংকেত দিতেন সন্ন্যাসী। একসময় আর ঘণ্টা বাজত না। তখন সবাই বুঝতে পারত, তিনি আর বেঁচে নেই।

এরপর সেই বাঁশের চোঙা সরিয়ে নিয়ে কক্ষের মুখ বন্ধ রাখা হত এক হাজার দিনের জন্য। এক হাজার দিনের পরে দেখা হত সেই সন্ন্যাসী মমি হয়ে গিয়েছেন কিনা। পদ্ধতি সফল হলে সেই দেহ তুলে এনে তাকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হত। তবে সবসময় প্রক্রিয়া সফল হত না। দেখা যেত, কোনও কোনও দেহে পচন ধরেছে। সেই দেহগুলি কবর দিয়ে দেওয়া হত। দেখা গিয়েছে, এদের সংখ্যাই বেশি।

আর যারা মমি হয়ে যেতেন? বৌদ্ধরা মনে করেন, তারা আসলে ধ্যানমগ্ন। সুদূর ভবিষ্যতে কোনও এক সময়ে আবার তারা জেগে উঠবেন। পথ দেখাবেন নির্বাণের! কোনও কোনও মতে, এই ধরনের ‘লিভিং বুদ্ধা’-র সংখ্যা মাত্র ২৪টি। আবার কারও মতে, সংখ্যাটা অনেক বেশি। কিন্তু তারা ইতিহাস থেকে হারিয়ে গিয়েছেন।

জাপানে গেলে এমন মমি মাত্র কয়েকটিই দেখতে পাওয়া যাবে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মমিটি শিন্নোকাই-শনিনের। ১৬৮৭-তে তার জন্ম। ৯৬ বছর বয়সে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মমি হওয়ার। দৈনিচি-বু মন্দিরে রয়েছে তার মমি। সবচেয়ে তরুণ মমিটি ১৯০৩ সালের। বুক্কাই নামে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর। ১৯৬০ সালে বিশেষজ্ঞরা তার দেহ পরীক্ষা করে চমকে উঠেছিলেন। এমনই চমৎকার ভাবে সংরক্ষিত রয়েছে সেটি।

আজ এসবই ইতিহাস। অতীতের গর্ভে আশ্রিত ‘সোকুশিনবুৎসু’-রা। কিন্তু সেই ফেলে আসা সময়ের মানুষদের দেখতে আজও জাপানের মন্দিরে ভিড় জমান মানুষেরা। মানুষের কৌতূহল ঠিকরে ওঠে এমন মমিদের সামনে দাঁড়ালে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের কাছে অবশ্য তারা মমি নন, মৃত্যুঞ্জয়ী অমর!

অর্থসূচক/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.