ব্যবসা সম্প্রসারণে পুঁজিবাজারে আসছে বেস্ট হোল্ডিংস

কাজ করছে ৩ গ্লোবাল ব্র্যান্ডের সাথে

বুক বিল্ডিং পদ্ধতির প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসছে ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের কোম্পানি বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড। কোম্পানিটি শেয়ার ছেড়ে বাজার থেকে ৩৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। এই অর্থ কোম্পানিটির বিভিন্ন চলমান প্রকল্প বাস্তবায়ন, ব্যাংক ঋণের একাংশ পরিশোধ ও আইপিওর ব্যয় নির্বাহে ব্যবহার করা হবে।

বুক-বিল্ডিং পদ্ধতির আইপিও প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিডিং বা নিলামের মাধ্যমে যোগ্য বিনিয়োগকারী (Eligible Investor) তথা প্রাতিষ্ঠানিক বিনীয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রি করা হবে। এই নিলাম আগামী ২০ নভেম্বর, ২০২৩ ইং, সোমবার বিকাল ৪ টায় শুরু হবে। এটি ২৩ নভেম্বর, ২০২৩ ইং, বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে।

বেস্ট হোল্ডিংস মূলত: পরিচিত পাঁচ তারকা হোটেল লো মেরিডিয়ান ঢাকা এর স্বত্বাধিকারী হিসেবে। তবে এ কোম্পানির মালিকানায় আরও কয়েকটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ চলছে। এগুলো হচ্ছে-এলএম রেসিডেন্স বসুন্ধরা, ম্যারিয়ট ভালুকা, ম্যারিয়ট কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স, লাক্সারি কালেকশন ভালুকা, লাক্সারি ভিলা ভালুকা এবং ধামশুর ইকোনোমিক জোন। এর বাইরে কৃষি খাতেও বিনিয়োগ রয়েছে কোম্পানিটির। কোম্পানিটি নোয়াখালী ও ভালুকায় পোল্ট্রি, ডেইরি, ফিশারিজ, লাইভস্টক খামার পরিচালনা করছে।

বেস্ট হোল্ডিংসের দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে; এগুলো হচ্ছে-আইকনএক্স হোটেলস লিঃ ও ধামশুর ইকোনমিক জোন লিঃ। দুটি কোম্পানিরই ৫১ শতাংশ করে শেয়ার ধারণ করছে বেস্ট হোল্ডিংস।

ম্যারিয়ট ভালুকা কমপ্লেক্সের লে-আউট

কোম্পানিটি বর্তমানে তিনটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের (Global Brand) সাথে কাজ করছে। এগুলো হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল হোটেল চেইন ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল (Marriott International) এর ব্র্যান্ড লো মেরিডিয়ান (Le Méridien), ম্যারিয়ট (Marriott) এবং প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড দ্যা লাক্সারি কালেকশন রিসোর্ট (The Luxury Collection Resort)। বেস্ট হোল্ডিংসের উদ্যোক্তারা অবশ্য আরও একটি গ্লোবাল ব্যান্ডের সাথে কাজ করছেন। সেটি হচ্ছে- যুক্তরাজ্যভিত্তিক গ্লোবাল এডুকেশন চেইন হেইলিবেরি (Haileybury)। তবে এর সাথে বেস্ট হোল্ডিংসের মালিকানার কোনো সম্পর্ক নেই।

বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালে। কোম্পানিটি ২০০৯ সালে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। লো মেরিডিয়ান হোটেল দিয়ে কোম্পানিটির ব্যবসা শুরু হয়। পরবর্তীতে অন্যান্য প্রকল্প খাতে ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়েছে।

বর্তমানে বেস্ট হোল্ডিংসের পরিশোধিত মূলধন ৯২৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।

আইপিওর প্রসপেক্টাস অনুসারে, সর্বশেষ অর্থ বছরে (২০২২-২৩) বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড ১১৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা নিট মুনাফা করেছে। কোম্পানিতে রিটেইন্ড আর্নিংস বা অবণ্টিত মুনাফা আছে ৪১৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে- ১ টাকা ২৩ পয়সা, যা আগের বছর অর্থাৎ ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে ১ টাকা ১২ পয়সা ছিল। তার আগের তিন বছরে কোম্পানিটির ইপিএস ছিল যথাক্রমে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে- ৪২ পয়সা, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে- ৯৯ পয়সা।।

সম্প্রতি বেস্ট হোল্ডিংসের বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শনের সময় ইপিএসের বড় তারতম্যের কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। জবাবে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান আমিন আহমদ বলেন, কোভিড-১৯ এর প্রভাবে দুই বছর ব্যবসা কম হওয়ায় ইপিএস কমে গিয়েছিল। কিন্তু কোভিডের আগের বছরের ইপিএসের সাথে বর্তমান ইপিএসের তেমন তারতম্য নেই।

বেস্ট হোল্ডিংসের বিভিন্ন প্রকল্প-

লো মেরিডিয়ান ঢাকা

লো মেরিডিয়ান একটি পাঁচ তারকা হোটেল। হোটেলটিতে ৪৫০ বর্গফুট আয়তনের ২০০ ডিলাক্স রুম রয়েছে; স্যুট রয়েছে ১০১ টি, আছে ২টি সুপরিসর এলএম স্যুট ও ১ টি প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট।

আগামী বছরের জুনের মধ্যে হোটেলটিতে আরও ৫৮টি রুম যুক্ত হবে।

এই হোটেলে বিভিন্ন আয়তনের ২টি বল রুম ও ১১ টি মিটিং রুম রয়েছে।

এলএম রেসিডেন্স বসুন্ধরা

এলএম রেসিডেন্স রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় কোম্পানির মালিকানাধীন ৯০ কাঠা জমির উপর নির্মিত হচ্ছে। এই প্রকল্পে ৬০০ বর্গফুট আয়তনের ১৯৮টি সার্ভিস স্যুট থাকবে, যা বাংলাদেশে দীর্ঘ অবস্থানকারী অতিথিরা ব্যবহার করবেন। এতে আরও থাকবে ৩২০০ বর্গফুট আয়তনের ১১৪টি সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্ট। প্রকল্পটি লো মেরিডিয়ানের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে। প্রকল্পটির ব্যয় ফ্ল্যাট বিক্রির আয় হতে নির্বাহ করা হবে।

ম্যারিয়ট ভালুকা

এটি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে অবস্থিত একটি পাঁচ তারকা হোটেল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক হোটেল চেইন ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধানে এটি পরিচালিত হবে। এই হোটেলে ২০৯টি ডিলাক্স রুম এবং ১৮টি স্যুট রয়েছে।

হোটেলটি বর্তমানে নির্মাণাধীন আছে। আগামী বছরের জুন নাগাদ এটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে পারবে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা।

নির্মাণাধীন ম্যারিয়ট ভালুকা’র বর্তমান অবস্থাম্যারিয়ট কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স

ম্যারিয়ট ভালুকার বাউন্ডারির মধ্যে এই কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ চলছে। এতে ১৩৮টি দোকান, ৮টি ব্যাংক শাখা, সিনেপ্লেক্স, ফুড কোর্ট, কনভেনশন হল ইত্যাদি থাকবে। এটিও আগামী বছরের মাঝামাঝি চালু হবে বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন।

লাক্সারি কালেকশন ভালুকা

লাক্সারি কালেকশন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের হোটেল চেইন ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনালের লাক্সারি ব্র্যান্ড রিসোর্ট। লাক্সারি কালেকশন ভালুকা হবে দেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার রিসোর্ট কমপ্লেক্স। বিশাল সবুজ এলাকার মধ্যে লেকের পাড়ে এই রিসোর্টের অবস্থান। রিসোর্টটিতে ১৮০টি ডিলাক্স রুম ছাড়াও থাকবে বিভিন্ন আয়তনের ২২টি বাংলো এবং আধুনিক সুবিধা সম্বলিত স্পা ও গলফ কোর্ট। প্রতিবেদকের সরেজমিন পরিদর্শনে বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিলক্ষিত হয়।

রিসোর্টটি ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে পারবে বলে জানিয়েছেন বেস্ট হোল্ডিংসের উদ্যোক্তারা।

লাক্সারি প্রাইভেট ভিলা

লাক্সারি কালেকশন রিসোর্টের পাশে নির্মিত হচ্ছে ১০০ টি প্রাইভেট ভিলা। এই ভিলাগুলো বাইরে বিক্রি করা হবে। আর বিক্রিত অর্থ বিনিয়োগ করা হবে লাক্সারি কালেকশন রিসোর্ট নির্মাণ প্রকল্পে।

এই বাংলোগুলো ম্যারিয়টের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে। এগুলো বসবাসের জন্য ২০২৫ সালের মার্চ মাস নাগাদ হস্তান্তর করা হবে। প্রতিবেদক ইতিমধ্যে নির্মিত ২টি বাংলো পরিদর্শন করেছেন।

ধামশুর ইকোনোমিক জোন

ধামশুর ইকোনোমিক জোন হচ্ছে বেসরকারী বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এর মোট আয়তন আনুমানিক ৮৪৬ একর। এটি ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত। আগামী ২০২৫ সালের জুলাই নাগাদ এই শিল্পাঞ্চলের উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত এবং শিল্প-প্লট লিজ দেওয়া শুরু হবে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তাগণ।

এগ্রো প্রজেক্টস

নোয়াখালী ও ভালুকায় বেস্ট হোল্ডিংসের রয়েছে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পোল্ট্রি, ডেইরি, ফিশারিজ ও লাইভস্টক।

গত শুক্রবার (১০ নভেম্বর) দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা কোম্পানির নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলো পরিদর্শনে গেলে কোম্পানির চেয়ারম্যান আমিন আহমদ কোম্পানিটির প্রকল্পগুলো নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।

এসময় আমিন আহমদ বলেন, বেস্ট হোল্ডিংসের প্রকল্পগুলো ব্যবসা সফল হওয়ার বিষয়ে আমরা শতভাগ আশাবাদী। সম্প্রতিক বছরগুলোতে ভালো মুনাফা অর্জনের চিত্রই তার প্রমাণ বহন করে।

তিনি বলেন, আমাদের ৪০০ কোটি টাকার বেশি রিটেইন্ড আর্নিংস রয়েছে। তাই কোভিডের মতো অনাকাঙ্খিত কোনো দুর্যোগ দেখা দিলেও বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে সমস্যা হবে না।

তিনি বলেন, প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছি। তখন কোম্পানির মুনাফা অনেক বেড়ে যাবে।

এ সময় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত একই খাতের অন্য কোম্পানির চেয়ে বেস্ট হোল্ডিংসের প্রফিট মার্জিন বেশি কেন?

এর উত্তরে বেস্ট হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান আমিন আহমদ বলেন, বেস্ট হোল্ডিংসের প্রফিট মার্জিন বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। হোটেলটিতে কক্ষ সংখ্যা বেশি এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু ও রুম ভাড়া অধিক হলেও পরিচালনা ব্যয় অন্যান্য হোটেলের চেয়ে সেই হারে অতিরিক্ত নয় বিধায় আমাদের মুনাফার হার বেশি।

কোম্পানির ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে আমিন আহমদ বলেন, আমাদের নিজস্ব যে মসলিন ব্র্যান্ড রয়েছে সেটিকে আরো বিস্তৃত করতে চাই। এরই মধ্যে বিদেশী ক্রেতাদের কাছে মসলিন ব্র্যান্ডের জামদানি, কাতান বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আমরা দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় আধুনিক সেবা ও সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন কিন্তু সাশ্রয়ী মূল্যে হোটেলের সেবা দেওয়ার বিষয় নিয়ে ভাবছি।

তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলার বিষয়টি তুলে ধরা হলে তিনি বলেন, এটি অভিযোগ মাত্র। প্রমাণিত কোনো বিষয় নয়। তিনি আইন মেনে মোট বিক্রয় মূল্যের বিপরীতে কর দিয়েছেন এবং আয়কর বিবরণীতে প্রদর্শিত আছে।

কোম্পানির বিশাল আকারের মূলধন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, লো মেরিডিয়ান নির্মাণের সময় গ্যাস সংযোগের সমস্যাসহ বেশ কিছু প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে না পারায় ব্যয় বেড়ে যায়। তাই বন্ড ও শেয়ার ইস্যু করে বাড়তি মূলধন সংগ্রহ করতে হয়েছে। পরে এই মূলধনের একটি অংশ নতুন একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে লাগানো হয়েছে। তাতে একদিকে কোম্পানির সম্পদ বেড়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে ব্যবসার প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা।

অর্থসূচক/এমআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.