তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা

ব্যাংক খাতে আবারো বেড়েছে খেলাপি ঋণ। চলতি বছরের জুন মাস শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। শতকরা হিসেবে মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও ঋণ পরিশোধ করছে না দেশের ব্যবসায়ীরা। ফলে লাগামহীনভাবে বাড়ছেই খেলাপি ঋণ।

তাদের মতে, করোনার কারণে গেল দুই বছর আরো সুবিধা পেয়েছে ব্যবসায়ীরা। ফলে ঋণ পরিশোধ না করেও নিয়মিত করে রাখা হয়েছে ওই সময়ের ঋণকে। এসব ঋণকে খেলাপির পরিমাপে আনলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ অর্থনীতিতেও চাপ সৃষ্টি করছে উল্লেখ করে তারা বলেন, খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই খেলাপি ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পাবে দেশের ব্যাংক খাত। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী উদ্যোগ নিতে হবে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, খেলাপিদের বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ এক লাখ ২৫ হাজার বলা হলেও বাস্তবে অনেক বেশি। কারণ পুনঃতফসিলকৃত ঋণ, আদালতে রিট করা ঋণসহ বেশ কিছু তথ্য এখানে যোগ হয়নি। এটি যুক্ত হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো অনেক বাড়বে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপিদের এমন সুবিধা দিচ্ছে যে, খেলাপিরা এখন মনে করছে আমি ঋণ পরিশোধ না করলে আগামীতে আরো বড় ছাড় পাবো। এ কারণে যতদিন ছাড় থাকবে ততদিন এ খেলাপি বাড়তেই থাকবে। এগুলো কমাতে হলে কঠিনভাবে আইন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

তিন মাস আগেও মার্চ প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সেই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। এছাড়া, এক বছরে অর্থাৎ গত বছরের জুনের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ২ লাখ ৫২ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বা ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে আলোচিত সময়ে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১০ লাখ ৪২ হাজার ৮৬৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৬২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ০১ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৬৭ হাজার ২৬৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ২ হাজার ৯৫৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা খেলাপি, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। আলোচিত সময়ে বিশেষায়িত তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হয়েছে ৪ হাজার ১৯৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এ অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এসময় তারা বিতরণ করেছে মোট ৩৫ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা।

জানা গেছে, করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে তাকে খেলাপি করা হয়নি। ফলে আদায় তলানিতে নামলেও খেলাপি ঋণ কম ছিল। ২০২১ সালে বিশেষ সুবিধার ছাড় কিছুটা কমিয়ে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নির্দেশনায় বলা হয়, গত ডিসেম্বরের শেষ কর্মদিবসের মধ্যে ঋণের ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলেই খেলাপি হবে না গ্রাহক। পরে মৌখিকভাবে এ ছাড় আরও ২০ দিন বাড়ানো হয়। এরপর খেলাপি ঋণ গিয়ে ঠেকে ১ লাখ ৩ হাজার ২৩ কোটি টাকায়।

এসব সুবিধা তুলে নেয়ার কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরিশোধের বিশেষ সুবিধা আরও এক বছর বাড়িয়ে দেন সাবেক গভর্নর ফজলে কবির। আর নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার যোগদানের এক সপ্তাহের মধ্যে খেলাপিদের আরও বড় সুবিধা দিয়ে মাস্টার সার্কুলার জারি করে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ ৫-৮ বছরে শোধ করা যাবে। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। আবার নতুন করে ঋণও পাওয়া যাবে। এছাড়া, খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলিকরণে এখন থেকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

ঋণ খেলাপিদের এমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ায় নানা সমালোচনার মুখে ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের নীতিমালায় সংশোধনী আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশোধনকৃত নীতিমালায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের খেলাপি হওয়া কোনো ঋণ সর্বোচ্চ তিনবার পুনঃতফসিল করা যাবে। আর ঋণ পুনঃতফসিলের পর ৬ মাস কিস্তি না দিলে আবার তা খেলাপি হয়ে পড়বে। প্রকৃত আদায় ছাড়া পুনঃতফসিল করা ঋণের সুদ আয় খাতে নেওয়া যাবে না। সব ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতার শর্ত তুলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুনঃতফসিল করা কোনো ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে খেলাপি করলে সেই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া নানা সুবিধার পরও গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করছে না। বিশেষ করে বড় ঋণগ্রহীতারা। যার কারণে বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণ।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.